মৃত্যুভয় আর ধার্মিকতা বিষয়ে প্রথম বড় কাজের অভিজ্ঞতা আমার পি এইচ ডি এর গবেষণা করার সময়। দুরশিক্ষনে আমাকে বিনা খরচে ছাত্র হিসাবে ওই বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহণ করেছিল এই শর্তে যে আমি সফলভাবে গবেষণা শেষ করে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জমা দেব; আর যদি তা অরিজিনাল এবং সফল হয় তাহলেই আমার সার্টিফিকেট এবং ডিগ্রি ওরা দেবে। পরবর্তীতে গবেষণার সার সংক্ষেপ Does Religiosity Help Muslims Adjust to Death?: A Research Note হিসাবে প্রকাশ হয় এবং তা আরও অন্যান্য গবেষণাতেও ব্যবহার হয়ে চলেছে।
এরপর, বয়স যখন ত্রিশ এর আশে পাশে, তখন আমার বড় সন্তান মোহাম্মদ সিয়াম সামিরের জন্ম এবং মৃত্যু আমাকে দারুণভাবে একই ধরনের গবেষণার দিকে আবারও ফিরিয়ে আনে। মৃত্যুর ব্যাপারে আমাদের যে মাত্রার অসহনিয়তা কাজ করে, এটাকে আমি স্বাভাবিক হিসাবে মানতে পারতাম না, কখনই। ছোটবেলা থেকেই বাবা-মাকে মৃত্যু দিয়ে হারানোর আতংক আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়িয়েছে। আমি বড় হবার পর যখন সিয়াম মারা গেল, তখন প্রথম সত্যিকারের মৃত্যু খুব কাছে থেকে দেখলাম। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারলাম, আমি যেভাবে মৃত্যুকে দেখছি তা গ্রহণ যোগ্য নয়, বরং ক্ষতিকর।
বেশ ভাল করেই জানতাম, শুধু আমি না, আমার দেখা বহু মানুষই এভাবে ভোগে। যার আপনজন মারা যায় সে কিভাবে শোক পালন করে তা দেখলেই এটা সহজে বোঝা যায়। একই ভাবে কারো নিজের অথবা তার আপনজনের প্রাণঘাতী কোন অসুখ ধরা পড়লে, মানুষ ঠিক একই ভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। ফলে জীবিত মানুষ তাদের জীবদ্দশাতেই নানা ভাবে এর প্রভাবে ভোগে। অথচ সবাই মারা গেছে, যাচ্ছে এবং যাবে। অর্থাৎ মৃত্যু খুবই নিয়মিত এবং প্রাকৃতিক একটা ঘটনা। এতটা নিয়মিত প্রাকৃতিক ঘটনা কেন এই মাত্রায় আসহনিয় হবে? – প্রশ্ন করলাম নিজেকে!
এটা ঠিক যে মৃত্যুকে ভয় করা, এড়িয়ে চলার মাধ্যমে জীবন টিকে থাকে। তাই প্রয়োজন মতো মৃত্যু ভয় স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু ঠিক কতটুকু ভয় করা স্বাভাবিক, সে নিয়েই আমার প্রশ্ন! উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, পৃথিবীর অনেক স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক ঘটনাই আমরা কামনা করি না, এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু সেগুলোকে আমরা মনে রেখেই এড়িয়ে চলি, না জানার মতো ভুলে গিয়ে নয়। হ্যাঁ ঠিক তাই, মৃত্যুকে আমরা এমন ভাবে ভুলে থাকি যেন আমরা একে মানি না, এমনকি জানিও না। আর এখান থেকেই আমার প্রশ্নের শুরু।
প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা সমাজেই জন্মের মতো করেই মৃত্যু বরণ করে; এটাকে অস্বাভাবিক রকম ভুলে থাকা বা ভয় করা স্বাভাবিক জীবন নয়। এতে জীবন অস্বাভাবিক পথে এগোয় যা শান্তির খাতিরে আমরা স্বাভাবিক হিসাবে মেনে নেই। উদাহরণ স্বরূপ একজন শত বছর বয়সীর দেহ লাইফ সাপোর্টে ফেলে রাখার কথা বলা যায়, অথবা বলা যায় আমরা আমাদের আপন জনদের কত সহজে বলি, “আমি কোন দিনই তোমাকে ফেলে দূরে যাবো না, সব সময়ই কাছে আছি।” শুনতে হৃদয়হীনের মতো মনে হলেও, এগুলোর কোনটাই স্বাভাবিক সত্য নয়, অথচ আমাদের জীবনে আমরা এগুলোকে শুধু স্বাভাবিক নয়, প্রয়োজনীয় বলে স্বীকৃতি দিয়েছি।
তবে এসব চিন্তার সময়, একইসাথে, আরও একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করলাম। শুধু মজারই না, এটাকে বিপদজনকও মনে হল। বুঝতে পারলাম যে নিজেকে পরকালে বিশ্বাসী বলে দাবি করলেও, দৈনন্দিন জীবনে মৃত্যুই আমার চোখে শেষ ঘটনা, এর পর আর কিছুতে আমি প্রকৃত অর্থে বা বাস্তবে বিশ্বাস করছি না। অথচ পরকালে বিশ্বাস আমার পরিচয়ের একটা বাধ্যতামূলক অংশ যা আমি কোন ভাবে ছাড়তে নারাজ। শুধু তাই না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আমি পরকালে বিশ্বাস করি। অথচ, অন্য সবার মতো আমি যেভাবে মৃত্যুকে দেখি বা উপলব্ধি করি তা প্রমান করে আমি বাস্তবে পরকালের অস্তিত্তে বিশ্বাস করি না!
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার মধ্যে এক ধরনের দ্বৈততা বা দ্বিমুখীতা বিরাজ করে যা কাম্য নয়। শুধু আমিই নই, আমার মতো আরও বহু মানুষ একই ভাবে দ্বিমুখী জীবন যাপন করছে যা কারোরই কাম্য হবার কথা নয়; মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এ দ্বিমুখীতা নানা অস্বাভাবিকতার জন্ম দিতে পারে। তাই দৃঢ় সংকল্প করলাম, মৃত্যু আতংক সমস্যার গোড়ায় গিয়ে নিজেকে এ সমস্যা থেকে মুক্ত করতে হবে। আর যদি তা পারি, তাহলে সেই অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নেব যেন সবাই এর সুবিধা পেতে পারে। তবে যেহেতু পৃথিবীতে নানা ধর্ম, মত, বিশ্বাসের মানুষ, কাজটা এমন ভাবে করতে হবে যাতে আমার সফলতা সবার কাজে আসে, এমনকি ধর্মহীন এবং বিশ্বাসহীনদেরও, ঠিক যেমন করে রোগের ওষুধ সব জীবিত মানুষের জন্য।
সহজ করে বললে, ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে আমি মৃত্যুভীতির বাড়াবাড়ির রহস্য ভেদ করার যে কাজ শুরু করি তার প্রাথমিক ফলাফলই হল Death and Adjustment Hypotheses যা ২০০৭ সালে বই হিসাবে প্রথম প্রকাশ পায়। আশা করছি এই লেখা গুলোর মধ্য দিয়ে সেই চিন্তা গুলোকে ধিরে ধিরে প্রকাশ করব যেন তা বাংলা ভাষা ভাষীদের কাছে সহজ বোধ্য আর উপকারী হয়।