সময়ের অতিবাস্তবতা

সতর্কতাঃ লেখাটা সম্পূর্ণই আমার ব্যাক্তিগত ধারণার ওপর ভিত্তি করে। যদিও নানা রেফারেন্স থেকে আইডিয়া গুলো এসেছে, তবু, লেখাটা নিতান্তই হাইপোথিসিস, এর বেশি কিছু নয়।

কোন সন্দেহ নেই যে সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা। আইনস্টাইনের রিলেটিভিটি থেকে শুরু করে পবিত্র কোরআনের সুরা আল আসর – সবই তা ইঙ্গিত করে। তাই আমার নিজের কাছে বরাবরেরই একটা প্রশ্ন ছিল – কেন? অনেক ভেবে যে জবাবটা নিজেকে দিয়ে স্বস্তি পেয়েছি তা আজ অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নিতে চাই।

আমি সব সময়ই আমার অস্তিত্তের দুটো মূল অংশ খুঁজে পাই। অর্থাৎ, মানব অস্তিত্তের দুটো অংশে আমি বিশ্বাস করি – ১) শরীরী, ২) অশরীরী। শরীরের যেমন অনেক গুলো অংশ আছে, অশরীরেরও তেমনই কয়েকটা অংশ আছে। ফ্রয়েড কিম্বা ইউং যে সকল কনসাস কিম্বা আনকনসাস অংশের বর্ণনা করেছেন তা থেকে শুরু ধর্মে উল্লেখ করা আত্মা, সবই হয়তো সেই অশরীরের অংশ।

আসলে অশরীর এর অবস্থান অশরীরী বাস্তবতায়, আর শরীর থাকে শরীরী বাস্তবতায়। মানুষ স্রষ্টার এক অদ্ভুত সৃষ্টি যা এই দুই বাস্তবতাকেই কাজে লাগায়। মানুষের অশরীর যখন শরীরের সাথে মিলে থাকে তখন মুলত শরীরের মাধ্যমেই দেখে শোনে, শুধুমাত্র ঘুম ছাড়া, যখন শারীরিক ভাবে অকেজো থেকেও মানুষ অশরীর দিয়ে দেখতে পায়, চলতে পারে।

শরীরী বাস্তবতায় অশরীরের ছায়াই হল সময়। সহজ করে বলতে গেলে, অপরিবর্তনশীল অশরীরকে যে ক্রমপরিবর্তনশীল শরীরের ভেতর দিয়ে পার হতে হয়, শরীরী বাস্তবতায় তারই বহিপ্রকাশ হল সময়। সময় পার হয়েছে কথাটার, তাই, সহজ অর্থ হল, অশরীর শরীরের পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছে বা তার মধ্য দিয়ে পার হয়েছে। বলে রাখা ভালো, শরীরের পরিবর্তন বলতে এখানে শারীরবৃত্তীয় সকল পরিবর্তন কে বোঝানো হয়েছে।

অশরীর অপরিবর্তনশীল হলেও শরীরের সাপেক্ষে এটা গতিশীল। শরীর পরিবর্তনশীল হলেও অশরীরের সাপেক্ষে এটা স্থির। এ দুটোর আপেক্ষিক অবস্থানের বহিঃপ্রকাশটাই সময়ের পরিবর্তন। যারা মিনকভস্কির চতুর্মাত্রিক জগত সম্পর্কে ধারণা রাখেন তারা হয়তো টাইম-স্পেস ওয়ার্ম এর কথা শুনেছেন; এটা মুলত শরীরের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবর্তনশীল অবস্থাকে একত্রে প্রকাশ করে যা পেট মোটা লম্বা এক কৃমির মতো দেখা যায়। শরীরকে মানুষের জীবদ্দশায় ঐ পেটমোটা কৃমির সাথে তুলনা করলে অশরীর তার ভেতর দিয়েই ভ্রমন করে, আর সেই ভ্রমণের পরিমাপ হয় সময় দিয়ে। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, তিন দিন সময় পার হয়েছে কথাটার অর্থ হবে, তিন দিনের ভেতরে যা শারীরিক যা উপস্থিতি ছিল অশরীর তার মধ্য দিয়ে ভ্রমন করেছে। সময়ের প্রকৃত অনুভূতিটা আসে অশরীর থেকে, যদিও তার পরিমাপটা আমরা দেখি শরীরী বাস্তবতায় ঘড়ির মাধ্যমে।

তাই সময় এমনই এক জিনিস যা শরীরী বাস্তবতায় অশরীরের উপস্থিতি ঘোষণা করে। প্রমান করে দেয়, আমরা শুধু শরীর দিয়ে তৈরি নই, আমাদের অশরীরী একটা অংশও আছে। একই সাথে সময় মনে করিয়ে দেয় পাশাপাশি চলমান দুই বাস্তবতার কথা, অর্থাৎ শরীরী এবং অশরীরী বাস্তবতা – ঠিক যেমনটা পবিত্র কোরআনে সুরা আর রাহমানে বলা হয়েছে পাশাপাশি প্রবাহমান দুই প্রবাহের কথা।

সব শেষে যা না বললেই নয়, সময় আমাদের প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয় যে আমরা আমাদের অশরীর দিয়ে কোন এক দিকে ধাবমান, ফলে পর্যায়ক্রমে আমরা জন্ম, জীবন, মৃত্যু এবং আরও অনেক কিছুরই মুখোমুখি হব – এটাই স্বাভাবিক। যখন অশরীর আর শরীর বিচ্ছিন্ন ভাবে অবস্থান করে, তখন সময়ের অবসান ঘটে। অশরীরী জীবন বা মৃত্যুর পরের জীবন যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য এটা ব্যাখ্যা করে দিতে পারে কেন পরকালকে অসীম বলা হয়েছে। আর তাইতো সময় সৃষ্টি জগতে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা।

One thought on “সময়ের অতিবাস্তবতা

Leave a reply to Mayeen Khan Cancel reply