গ্রামের পুকুর একদিন অদুরের নদীকে বলল, “কেমন মানুষ তুমি, যেখানে সেখানে যাও, যার তার সাথে মেশো! আমাকে দেখ এই গণ্ডির বাইরে আমি কোথাও যাই না!” নদী বেচারা হাসি মুখে জবাব দিল, “প্রবাহই তো আমার বৈশিষ্ট, এটা বাদ দেব কিভাবে? তাছাড়া সমুদ্রকে দেখ, কি বিশাল, কোন কুল কিনারাই নেই!” পুকুর বিরক্ত হয়ে জবাব দিল, “সমুদ্রের আবার কুল কিনারা কি, তার তো জাতেরই ঠিক নেই, নদী এলেই তাকে গ্রহণ করে নেয়!” নদী হতাশ হয়ে আর জবাব না দিয়ে সমুদ্রের দিকে বয়ে চলল, আর অহংকারি পুকুর তার গণ্ডির মাঝে সুখেই থাকল যতদিন না বানের পানি আসলো!!
ওপরের গল্পটা সমাজ ও সামাজিকতার কথা ভেবেই লেখা। দৈনন্দিন কথোপকথনে খুব সহজেই আমরা যে বিষয় গুলোতে মনোযোগ দেই তার একটা হল, সমাজ। মানুষ সামাজিক জীব। এই সমাজকে ঘিরে আমরা নানা সবকও একে অন্যকে দিয়ে থাকি। কিন্তু প্রশ্ন হল সমাজ আসলে কি? অন্তত, আমাদের কাছে কি?
প্রাথমিকভাবে, যাদের সাথে আমাদের চলাফেরা, ওঠা বসা এদের নিয়েই আমাদের সমাজ। অর্থাৎ আশেপাশের মানুষদের নিয়েই আমাদের সমাজ। অথচ, আমরা এমনটা অনেক সময়ই দেখি যে একজন মানুষ তার চারপাশের সবাইকে বর্জন করে দুরের কারো সাথে সক্ষতা গড়ছে। এর কারণও খুব সহজ – দৈহিক পারিপার্শ্বিকতার চেয়ে আত্মিক পারিপার্শ্বিকতা সমাজ গড়তে বেশি প্রয়োজন। এক কথায়, এর মানে হল, আমরা জীবিত, সবাক এবং সচল মানবদেহ গুলোর সাথে মেলামেশা করি মূলত তাদের ভেতরের সত্ত্বাটাকে উদ্দেশ্য করে।
প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে ভার্চুয়াল মিডিয়ায় অন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করে পুরনাংগ সামাজিক অনুভূতি আসেনা কেন? আমার কাছে এর জবাব হল, মানুষের ভেতরের সত্ত্বার সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হল ঐ একই মানুষের দৈহিক কাঠামো এবং সংশ্লিষ্ট অনুভূতি গুলো। তাই ভার্চুয়াল মিডিয়ায় যখন আমরা কোন মানুষের সাথে যোগাযোগ করি, তখন ঐ কর্মকাণ্ড ঐ মানুষের দৈহিক অনুভূতি গুলোর মাধ্যমেই তার মনকে স্পর্শ করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যখন কেউ আমার ফেসবুক পোস্টে লাইক দেয় তখন তা আমার মস্তিষ্কের পুরস্কার সংক্রান্ত অংশকে সচল করে। ফলে আমি মনের দিক থেকে ভালো বোধ করি। হতে পারে কারো সাথে সাক্ষাতে একটা মুচকি হাসি এর চেয়েও বেশি ভালো অনুভূতি আমাদের মনে আনতে পারে। তাই সরাসরি যোগাযোগ, ভার্চুয়াল যোগাযোগের চেয়ে সব সময়ই এগিয়ে থাকবে।
যাহোক, উপরের কথাগুলো বলার পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল তা হল, নিজেদের মনে করিয়ে দেয়া, মানুষের শরীরের ভেতরে বৃহত্তর এক মানুষ থাকে যা সামাজিক কর্মকাণ্ডে ঐ শারীরিক মানুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। এখন, আসুন, নিজকে প্রশ্ন করি, যখন আমরা অন্য কারো সাথে সামাজিক উদ্দেশ্য মেলামেশা করি, তখন এই ভেতরের মানুষের কতটুকু গুরুত্ব আমরা দেই ? সুন্দর বাহ্যিক চেহারা, সুন্দর আচরণ, সুন্দর বাচন, কিম্বা সুন্দর সাজানো পরিবেশ – এ সবই ভেতরের মানুষকে সহজ সুন্দর বার্তা পৌঁছে দিতে পারে; তবে মূল শর্ত হল, ভেতরের মানুষটার সাথে যোগাযোগের নুন্যতম আগ্রহ থাকতে হবে। যদি তা না থাকে, আর শুধুই সৌন্দর্য, প্রাচুর্য কিম্বা উৎকৃষ্টতার প্রদর্শনী করে আপেক্ষাকৃত শ্রেষ্ঠ হবার বাসনায় আমরা একে অন্যের সামাজিক সংস্পর্শে যাই, তাহলে তা হবে মন-প্রানহীন দুটো চলমান মানব দেহের যোগাযোগ। এতে ভেতরের মানুষটাকে শুধুই অগ্রাহ্য করা হয়, আর ফলাফল সামজিকতার ঠিক বিপরিত – অনেকটা শত্রুতার মতো।
তাহলে প্রশ্ন হল, এই শারীরবৃত্তীয় সমাজে কিভাবে অন্যের ভেতরের মানুষটার সাথে যোগাযোগ রাখবো, সত্যিকারের সামাজিক হব? খুব কঠিন কাজ। তবে সম্ভব। এর জন্য যা দরকার তা হল, অন্য মানুষের বাহ্যিক আড়ম্বরে অভিভূত না হয়ে তার ভেতরের সত্ত্বাটাকে গুরুত্ব দেয়া। এর সাথে আরও দরকার হল, একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত নিজের ভেতরের দরজা খুলে দেয়া; ফলে অন্য কেউ প্রথমত বাহ্যিক আড়ম্বরে ব্যস্ত থাকলেও সতিকারের সামাজিক সম্পর্কের স্পর্শে তার ভেতরের মানুষটাও হয়তো জেগে উঠবে – সত্যিকারের সামাজিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে।
কেন আমরা সামাজিক ভাবে বাঁচতে চাই, কি আছে সমাজে? জবাবটা বেশ জটিল। আমাদের ভেতরের সত্ত্বা গুলো জন্মসুত্রে একটা পর্যায়ে গিয়ে একে অন্যের সাথে যুক্ত, ঠিক যেমন হাতের আঙ্গুলগুলো হাতের তালুতে গিয়ে একে অন্যের সাথে মিলে যায়। আর ভেতরের স্বত্বাটাই যেহেতু আমাদের মূল সত্ত্বা, ভেতরের সত্ত্বার প্রাচুর্যই আমাদের জন্য সত্যিকারের প্রাচুর্য, যা কেবল এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে সতিকারের সামাজিক বন্ধনেই পায়। বাহ্যিক বা শারীরবৃত্তীয় প্রাচুর্য ভেতরে না পৌঁছলে তা মূল্যহীন – হোক তা দৈহিক সৌন্দর্য কিম্বা অর্থ বিত্ত।
আমরা অনেক সময়ই সমাজের মন্দ সব বৈশিষ্টের কারণে সমাজকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেই, উদ্দেশ্য মন্দ থেকে দূরে থাকা। কিন্তু সমস্যা হল শারীরবৃত্তীয় সমাজকে দূরে ঠেলতে গিয়ে আমরা আমাদের উৎস থেকেও সরে যাই, অনেকটা হাতের তালু থেকে অঙ্গুল পৃথক করে ফেলার মত। তাই যে সমাজে মন্দ বাহ্যিকতার অভাব নেই, সেখানে সামাজিকভাবে বাঁচতে হলে বাহ্যিক মন্দকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে ভেতরের সুন্দরকে সুযোগ করে দিতে হবে। আর দুরভাগ্য বশত যদি ভেতরেও সুন্দর না থাকে তাহলে সে সামাজিক সঙ্গ ত্যাগ করাই শ্রেয়। তবে বলে রাখা ভালো, মানুষ মাত্রই ভেতরে সুন্দর কিছু থাকবে – এটাই তো স্বাভাবিক!
Reblogged this on ত্রিভুজ.
LikeLike