নিসঙ্গতা আর স্রষ্টা

প্রথমেই বলে নেয়া দরকার, এই লেখাটা তাদের জন্য যারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন বা অন্তত তা দাবি করতে পছন্দ করেন। এ পৃথিবীতে মানুষের জীবনধারা নানা রঙের, নানা আকারের। কারো অর্থ নেই, কিন্তু সঙ্গ আছে। আবার কারো অর্থ আছে তবে সঙ্গ নেই। আবার অবস্থার বদল হয়ে মানুষ ঠিক বিপরিত ধরণের জীবনেও চলে যায়। দুই চরম অবস্থাতেই মানুষ কষ্টের জীবন যাপন করবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার এ থেকে বের হয়ে আসার পথও খুঁজতে হবেন ঐ মানুষকেই। এ লেখার উদ্দেশ্য সেই পথ খোঁজাকে কেন্দ্র করে।

যে বিশ্বাসীর অর্থ নেই, তার জন্য প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হল অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করা এবং সে চেষ্টাতে স্রষ্টার সাহায্য কামনা করা। এ পদ্ধতি যার পছন্দ নয়, তার সহায় কেবল স্রষ্টাই হতে পারেন, আমার মতো মানুষ নয়। অন্য দিকে বিত্তবানের নিঃসঙ্গতা এর চেয়ে একটু জটিল। কখনো কখনো বিত্তবানের মন মানসিকতা তাকে নিঃসঙ্গতার কোনায় ঠেলে দেয়, আবার কখনো তাদের অপারগতা আর দুর্বলতা। যে বা যারা সামাজিক জীবনের মধ্যে এর সমাধান খুঁজছেন, তারাই সম্ভবত ঠিক। তবে বার্ধক্য জনিত বা অন্য যে কোন চরম অবস্থার কারণে যারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন তাদের জন্য ভিন্ন মাত্রার এক সমাধান রয়েছে, যদি তারা স্রস্টায় বিশ্বাসী হন। এমনকি, অন্য যে কোন অবস্থার নিঃসঙ্গতাও এর মাধ্যমে কমিয়ে আনা যেতে পারে।

আমরা যারা বিশ্বাসী তারা সাধারনত নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনা করি। প্রার্থনার নিয়ম-কানুন মেনে সময় মতো প্রার্থনা সারা এক গুরুত্বপূর্ণ দৈনন্দিন কাজ আমাদের জন্য। আমরা জানি, এ প্রার্থনা স্রষ্টার উদ্দেশ্যে। এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে। মুশকিল হয় তখন, যখন এতো নিয়ম মাফিক প্রার্থনা আর শ্রমের কেন্দ্র বিন্দু স্রষ্টাকে আমরা আমাদের কল্পনায় সীমাবদ্ধ রাখি, বাস্তবে স্থান দেই না। আরেকটু সহজ করে বলি। যিনি প্রার্থনা করেন তিনি প্রার্থনা চলা কালিন এমন অনেক কিছুই অনেক সময় করেন বা ভাবেন যা তিনি অন্য একজন সম্মানিত মানুষকে সামনে রেখেও কখনো করবেন না, সৃষ্টিকর্তার সামনে তো দূরে থাক। এমনটা হবার পেছনে যে প্রধান কারণ তা হল, আমাদের বাস্তব অনুভূতি স্রষ্টাকে মোটেও অনুভব করছে না, বা অনুভব না করলেও যে দৃঢ় বিশ্বাসে ধারন করা সম্ভব তাও করছেনা। ফলে প্রার্থনা হয়ে গেছে অনেকটা নিয়ম মাফিক ব্যায়াম এর মতো, ওখানে স্রষ্টার বিশেষ কোন জায়গা নেই। ফলে প্রার্থনার বাইরের সময় গুলোতে স্বভাবতই স্রষ্টা আরও অনুপস্থিত। নিচের উদাহরণ এর কথাই ভাবুন।

হাসান সাহেব মসজিদে গেছেন নামাজ পড়তে। যাবার সময় পথে অপবিত্র কিছু তার কাপড়ে লেগে থাকতে পারে এ সন্দেহে তিনি ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। মসজিদে নানা জনের সাথে পরামর্শ করে শেষমেশ যখন কিছুতেই শান্তি পেলেন না, ঠিক করলেন বাসায় ফিরে কাপড় বদলে নামাজ পড়বেন। পথে ফিরতে ফিরতে অপরিচ্ছন্ন রাস্তা এবং তার সমাধান নিয়েও অনেক ভাবলেন। ঘরে ফিরে কাপড়ই শুধু বদলালেন না, তার আগে গোসল করে নিলেন। তার এই ধর্ম পরায়নতার পরিচয় পেয়ে তার স্ত্রীও ভীষণ অবাক আর খুশি হলেন। ভাবলেন, সন্তানরা যেন ঠিক বাবার মতোই হয়।

এখন ভাবুন, উপরের উদাহরণে হাসান সাহেবের জীবনে স্রষ্টার বাস্তব উপস্তিতি কোথায়? যে স্রষ্টা তার প্রার্থনা কবুলের মালিক, হাসান সাহেব একবারের জন্যও তাঁর দ্বারস্থ হবার কথা ভাবেন নি, বাস্তবে তাঁর কোন উপস্থিতি হাসান সাহেবের জীবনে নেই। বরং স্রষ্টা যেন হুকুম দিয়েই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন, এখন সব দায় দায়িত্ব হাসান সাহেবের – স্বর্গ নরক সব। এমনভাবে স্রষ্টাকে বাস্তবে অনুপস্থিত রেখে যারা ধার্মিক হয়ে চলেছেন, তাদের নিঃসঙ্গ জীবন আসলেই খুব কঠিন হতে পারে। শুধু তাই না, এরকম অবস্থাতেই অনেক সময় আমরা বলি – ধর্মে বলেছে এই কথা, তবে বাস্তবে আমরা অন্যটা করি – যেন স্রষ্টা আর তাঁর ধর্ম অন্য জগতের কিছু, আমাদের বাস্তবে এর কিছু নেই।

এবার ভাবুন, এমন এক মানুষের কথা যে বিশ্বাস করে স্রষ্টা এমন এক বাস্তব যা বাবা, মা, ভাইবোনের মতোই কিম্বা তাঁর চেয়েও বেশি, কিন্তু কম নয়। সে মানুষ যখন সমস্যায় পড়বে, প্রার্থনার ভেতরে বা বাইরে, সে সহজেই স্রষ্টাকে বলবে – আমাকে দয়া করে সাহায্য করুন। সাহায্য পাওয়া বা না পাওয়া পরের কথা, সে অন্তত আর একা বোধ করবে না। যখন কেউ তার পাশে নেই এবং নিঃসঙ্গতা তাকে যন্ত্রণার হুমকি দিচ্ছে, অন্তত সে সরল ভাষায় তার কষ্টের কথা স্রষ্টার কাছে বলার মানসিকতা রাখবে। স্রষ্টা তাকে জবাব দেবার আগেই তাঁর নিঃসঙ্গতার নিকষ কালো আঁধারে ছেদ ঘটবে। আর যার জন্য স্রষ্টা শুধুমাত্র প্রার্থনায় সীমাবদ্ধ নেই, বাস্তবের প্রতি মুহূর্তে উপস্থিত তার জন্য নিঃসঙ্গতা বরং বেশ অস্বাভাবিক ঘটনাই হবার কথা।

মানুষের পৃথিবীবাস একা, ধ্যানে মগ্ন থাকার জন্য নয়, হোক সে ধ্যান স্রষ্টাকে নিয়ে। মানুষ অন্য আরেক মানুষের মাঝে সঙ্গ খুজবে এটা শুধু স্বাভাবিকই নয়, জরুরীও। কিন্তু যতক্ষণ অন্য মানুষ তাকে সঙ্গ না দেবে, ততক্ষণও তার একা থাকা অযৌক্তিক যদি তিনি স্রষ্টায় বিশ্বাসী হন। তাছাড়া প্রতিটা মনুষ্য সঙ্গ কখনো না কখনো শেষ হবেই। তাই একজন বিশ্বাসীর জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে, জাঁকজমক জীবনের মধ্য থেকেই স্রষ্টার বাস্তবতা আর সঙ্গে অভ্যস্থ হওয়া। ফলে যদি চারপাশের সব কিছু ভেঙ্গেও পড়ে, তখন আর কেউ না হোক অন্তত স্রষ্টা তার প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে থাকবেন।

One thought on “নিসঙ্গতা আর স্রষ্টা

Leave a comment