জীবনে কখনো সিগারেটে একটা টানও দেইনি। কখনো মনেই হয়নি মদ পানের কথা। অন্যান্য নেশার ব্যাপারে আমার মানসিকতা হল- এরা ভয়াবহ ফাঁদ, কোন ভাবেই যেন এতে ধরা না পড়ি। কিন্তু তার মানে কি আমি নির্ভরশীলতা-মুক্ত জীবন যাপন করতে পেরেছি? দেখি বিশ্লেষণ কি বলে!
জীবনের প্রথম পরশ মায়ের আর বাবার। একটা সময়ে তারা জীবন বাঁচাতে সাহায্য করেছে। তারপর দিনে দিনে বড় হয়েছি, কিন্তু মা-বাবার প্রয়োজন কমেছে বলে মনে হয় না। একমাত্র তাদের মৃত্যুর পর খুব কঠিন ভাবে বুঝতে পেরেছি, মা-বাবা ছাড়াও বাঁচা সম্ভব। অথচ তাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সকালে ঘুম থেকে উঠে কিম্বা রাতে ঘুমাতে যাবার আগে, যখনই হোক, তাদের কোন বিকল্প ছিল না। দেশ ছাড়া তো দূরের কথা শহর ছাড়িনি পরিবার থেকে দূরে যেতে হবে বলে। বন্ধু বান্ধব বিসিএস কিম্বা অন্য যেকোনো উচ্চতর পরিক্ষা দিয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে, আমি তখন অন লাইন এডুকেশন খুঁজেছি, কারণ অন্য সব গুলোর জন্যই ঘর ছাড়তে হবে। কি ভীষণ দুর্বল আর অসহায় আমি! তারপর যে দিন থেকে মা-বাবা নিশ্চিত ভাবেই দূরে চলে গেলেন, আমি এক নতুন জীবনে উপনিত হলাম। কি ভাবছেন, আমি স্বার্থপর? না, আমি শুধুই সত্য কথা বলছি। বাবা মায়ের মৃত্যু এখন পর্যন্ত আমার কাছে এতটাই কঠিন যে বেশির ভাগ সময়ই আমার মনে করতে কষ্ট হয় যে আমারও বাবা মা ছিল; তাদের স্মৃতি আড়ালে রাখাটাকেই মন শ্রেয় মনে করেছে। কিন্তু বেঁচে আছি, খোদার ইচ্ছায় ভালও আছি।
বাবা-মায়ের মতো বড় করে না হলেও জীবনে আরও বহু জিনিস এসেছে। প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই মনে করেছি, এটা ছাড়া আমার চলবে না! ভাই, বোন, বন্ধু এমনকি সন্তান পর্যন্ত! যার যখন যেখানে যাবার সে ঠিকই চলে গেছে, জীবনটাও থেমে থাকেনি, বরং আরও উন্নত জীবনে রূপান্তরিত হয়েছে। হয়তো আবারো ভাবছেন, কত স্বার্থপর আমি! না, আমি শুধুই সত্য বলছি। প্রতিবারই যখন কিছু না কিছু হারিয়ে বেঁচে থেকেছি, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে, স্বনির্ভরতা বেড়েছে, সর্বোপরি অন্তরে কৃতজ্ঞতা আর বিশ্বাস বেড়েছে।
তাহলে প্রশ্ন আসে, এগুলো সবই কি এক ধরণের নেশা ছিল? না। এগুলো মুলতঃ ছিল প্রয়োজন। তবে প্রয়োজন ফুরানোর পর যদি এগুলো আঁকড়ে থাকি, তখনই পথ খুলে নেশার। না, আমি বলছিনা যে বাবা,মা, পরিবার, বন্ধু এগুলো নেশা জাতীয় কিছু, যেমন গাঁজা কিম্বা সিগারেট। তবে এটা ঠিক, নেশার ভিত্তিই হল অপ্রয়োজনীয় অভ্যাসে। কিভাবে? চলুন দেখি কিভাবে!
খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। যার রোগ হিসাবে বিষণ্ণতা থাকে তাকে বিষণ্ণতার প্রতিষেধক ঔষধ দেয়া যায়। রোগের (উপসর্গের) মাত্রা অনুযায়ী ঔষধের মাত্রা নির্ণয় করা হয়। যতদিন রোগের মাত্রা একই রকম থাকে ততদিন ঔষধের মাত্রাও অপরিবর্তিত থাকে। রোগের মাত্রা পরিবর্তনের সাথে সাথে ঔষধের মাত্রাও একই হারে পরিবর্তন করা প্রয়োজন পড়ে। রোগ যদি ধীরে ধীরে কমতে থাকে ঔষধও ধীরে ধীরে কমানো হয়। তারপর রোগ শূন্যের কোঠায় এলে ঔষধও শূন্যের কোঠায় আনা হয়। এতে নেশা হওয়ার কোন সুযোগ থাকে না কারণ প্রয়োজনের বাইরে ঔষধের কোন ব্যবহার করা হয় না। অথচ সেই একই ঔষধ যদি কেউ প্রয়োজনের বাইরে ব্যবহার করে তাহলে নেশা বা নির্ভরশীলতার প্রচুর সম্ভাবনা থাকে।
দরকারের বাইরের জিনিসটা যখন শুধু মানসিক প্রভাব ফেলে, তখন নির্ভরশীলতা (যাকে সোজা কথায় যাকে আমরা নেশা বলি) হয় মানসিক; আবার অদরকারী জিনিসটা যখন শারীরিক-মানসিক দু রকমের প্রভাব ফেলে তখন নির্ভরশীলতাও একই সাথে দু রকমের হয়। মানুষ হবার সুবাদে আমরা যা কিছুই করি তা আমাদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। তবে কেউ যদি দরকারের বাইরের কোন অখাদ্য খায় আর তা ধরে না রাখতে পারে বা কষ্ট পায়, তা থেকে নেশা বা নির্ভরশীলতা আশা করাটা বাস্তব নয়। অর্থাৎ, যখন দরকারের বাইরের কাজটা আমাদের জীবনে ঘটবে, তখন শুধু ক্রিয়ার সংঘটন না, কাজটা সর্বোপরি কর্তার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে। একইসাথে, আমাদের সংস্কৃতিতে আনন্দ, ফুর্তি ইত্যাদিকে দরকারের বাইরের কাজ হিসাবে অনেকে শ্রেনিবিভাগ করেন, যা সব দিক থেকেই ভুল। অনেক সময় খুব ছোট খাটো অগ্রাহ্য করার মতো দরকারকেও আমরা অদরকারী শ্রেণীতে ফেলি, যা আরেকটি ভুল।
অনেক সময় দরকারের সংজ্ঞা নিয়েও টানাটানি পড়ে। যা একজনের কাছে দরকার তা হয়তো অন্য জনের কাছে অদরকারী। মনে রাখতে হবে, সৎ ভাবে চিন্তা করে যা আমার জন্য অদরকারী অথচ আমি তা সহজেই করে চলেছি, সেটা আমার জন্য নেশার ঝুঁকি রাখতে পারে; পুরো ব্যাপারটাই ব্যক্তি কেন্দ্রিক। হতে পারে যা আমার জন্য নেশার সম্ভাবনা রাখে তা অন্য আরেকজনের জন্য হয়তো তা নয়। যে নিজের সাথে অসৎ হয়ে অদরকারিকে দরকারি সাজিয়ে বদঅভ্যাস গড়ে তোলে, তাকে সারাতেই সমাজকে পদক্ষেপ নিতে হয়।
এতক্ষণ যে অদরকারী কাজ করার কথা দিয়ে নেশাকে উপস্থাপন করছি সেখানে একটা বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ নেশাকারক কাজ বা বস্তু মানুষকে কিছু না কিছু দেয় যা কোন না কোন ভাবে সেই মানুষের কাছে প্রথম গ্রহণযোগ্য এবং পরে অভ্যাসে পরিণত হয়। যারা বিষণ্ণতার ঔষধের দেয়া ঘুম ঘুম ভাবটার জন্য দরকারের বাইরে ঔষধটাকে ব্যবহার করে, পরবরতিতে নিয়মিত সে ঔষধ খাবার কারণ হিসাবে ঘুমকেই পাওয়া যায়; অথচ শুরুর অভ্যাসটা হয়তো কৌতূহল বশতঃ ছিল, ঘুমের অভাবের জন্য নয় । আবার অনেক সময়, যার পর্যাপ্ত ধারণা নেই এমন কেউ হয়তো ঘুমের চাহিদা থেকে ভুল রকমের ঔষধ খেয়েও নেশার খপ্পরে পড়তে পারে। তাই, ঔষধের ক্ষেত্রে কোনটা আপনার দরকার তা বিশেষজ্ঞের সাহায্য ছাড়া সিদ্ধান্তে আসাটা খুব ভুল।
আলোচনাকে সহজ করতে শেষ করবো সহজ একটা উদাহরণ দিয়ে। যে খাবার ক্ষুধা মিটাতে বা অন্য কোন প্রয়োজন মিটাতে নয়, বরং শুধুই মন ভরাতে, তার নিয়মিত ব্যবহার খুব সহজেই নেশায় পরিণত হতে পারে। এমনকি দরকারের চেয়ে বেশি খাওয়াটাও আমি এর মধ্যে ফেলব। একটা নেশা একজন মানুষের জন্য পরিনতিতে হাজারো নতুন চাহিদা তৈরি করে। কখনো কখনো সেই নতুন চাহিদা গুলো ক্ষতি, খরচ, পেরেশানির উৎস হয়ে দাঁড়ায়। জীবন জটিল থেকে জতিলতর হতে থাকে। আমরা ভুলেই যাই যে গোড়ার অদরকারী কাজটা এখন অনেকগুলো জরুরী দরকার সৃষ্টি করে ফেলেছে যা শুরুতে মোটেও দরকারি ছিল না। ভেবে দেখুন, সিগারেটের ব্যবহারের কারনেই ভেপিং বা ই-সিগারেট সমাজে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
আসলে নেশা প্রতিরোধের জন্য পৃথিবীতে নানা পদ্ধতি চালু হলেও, অদরকারীকে এড়িয়ে চলাটা সেভাবে চালু হয়নি। হতে পারে, শৈশব থেকে যদি আমরা সত্যিকারের অদরকারী এড়িয়ে চলার মানসিকতা রাখতে পারি, তাহলেই নেশা সমাজ থেকে সমূলে উৎপাটিত হবে।
Reblogged this on ত্রিভুজ.
LikeLike