বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও প্রযুক্তিতে অসাধারণ অগ্রগতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষ এখনো মৃত্যুকে নিয়ে গভীরভাবে অস্থির। ভয়, অস্বীকার, এড়িয়ে চলা, আর মানসিক বিভাজন—এগুলো আজও ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পুরো সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে চলেছে।
ডেথ অ্যাডজাস্টমেন্টের মনোবিজ্ঞান এই স্থায়ী অস্থিরতার কারণ ব্যাখ্যা করে এবং দেখায় কীভাবে তা অর্থপূর্ণভাবে সমাধান করা যেতে পারে। এই বইয়ে একটি মানবিক ও মৌলিক তত্ত্ব কাঠামো উপস্থাপন করা হয়েছে—ডেথ অ্যান্ড অ্যাডজাস্টমেন্ট হাইপোথিসিস (DAH)।
দীর্ঘ সময়ের ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা, তাত্ত্বিক কাজ, বিভিন্ন সংস্কৃতির বিশ্লেষণ এবং গভীরভাবে পর্যালোচিত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে মোহাম্মদ সামির হোসেন DAH-কে একটি পূর্ণাঙ্গ মনোবৈজ্ঞানিক মডেল হিসেবে তুলে ধরেছেন। এই মডেল ব্যাখ্যা করে মানুষ কীভাবে মৃত্যু সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে, কেন মৃত্যু মানসিকভাবে অসহনীয় হয়ে ওঠে, এবং প্রকৃত অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য কী কী শর্ত প্রয়োজন।
বইটি তিনটি পরস্পর-সংযুক্ত ধাপে এগিয়েছে।
পার্ট ওয়ান একটি প্রচলিত ধারণা—মৃত্যু মানে মানুষের অস্তিত্বের নিশ্চিত বিনাশ -কে চ্যালেঞ্জ করে। বিজ্ঞান জীবনের জৈবিক সমাপ্তি খুব নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু অস্তিত্বের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি প্রমাণ করতে পারে না। মৃত্যু নিশ্চিত বিনাশ—এই ধারণাকে সত্য ধরে নিলে, সামির দেখান, তা মানসিক দ্বন্দ্ব কমায় না; বরং দীর্ঘমেয়াদি মৃত্যু-ভয় আরও বাড়িয়ে তোলে।
পার্ট টু বিশ্লেষণ করে কেন বিনাশকেন্দ্রিক চিন্তা টিকে থাকে যদিও সেই ব্যক্তি বা সমাজ ধারাবাহিকতা, আধ্যাত্মিকতা বা পরজীবনে বিশ্বাসের কথা বলে। এখানে নৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও বস্তুগত ভোগের আসক্তির ভূমিকা স্পষ্ট করা হয়েছে। যখন নৈতিক জবাবদিহিতা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন পরকালের ধারণা মানসিকভাবে আড়াল করে রাখা হয়, ফলে মৃত্যু ধীরে ধীরে চূড়ান্ত সমাপ্তি হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়। এতে সাময়িকভাবে মানসিক চাপ কমতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা অস্তিত্বগত ভয় ও অস্থিরতা তৈরি করে।
পার্ট থ্রী, যা বইটির মূল তাত্ত্বিক অবদান, অ্যাডজাস্টমেন্টের গণ্ডি ছাড়িয়ে ‘অরিয়েন্টেশন’-এর দিকে যায়। এখানে দেখানো হয়েছে—শুধু মৃত্যু-ভয় কমে যাওয়া যথেষ্ট নয়। ভয় কমলে মানুষ আরও গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি হয়: জীবনের উদ্দেশ্য কী, আমি কে, দেহের বাইরে পরিচয়ের ধারণা কী, ধারাবাহিকতা ও অর্থ কোথায়। অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, নৈতিক কাঠামো, দেহের বাইরে পরিচয়, এবং অর্থপূর্ণ সংযোগ—এই উপাদানগুলো একসাথে না থাকলে, অ্যাডজাস্টমেন্টের পরও জীবন দিশাহীন হয়ে পড়তে পারে।
বই জুড়ে বিজ্ঞানকে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, কিন্তু অস্বীকার করা হয়নি। জীবন ও মৃত্যুর শারীরিক দিক বোঝার জন্য বিজ্ঞান অপরিহার্য। তবে অর্থ, ভয়, পরিচয় ও নৈতিক সিদ্ধান্ত—এসব তাৎক্ষণিক মানবিক প্রয়োজনগুলো সমাধান করার জন্য বিজ্ঞান একা যথেষ্ট নয়। DAH এমন একটি কাঠামো প্রস্তাব করে যেখানে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, মনোবৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি, নৈতিক দিকনির্দেশনা ও অস্তিত্বগত অর্থ—সবকিছু একসাথে সহাবস্থান করে, কোনো রিডাকশনিজম বা ডগমা ছাড়া।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ডেথ অ্যাডজাস্টমেন্টের মনোবিজ্ঞান কোনো ধর্মীয় প্রচার নয়, আবার বিমূর্ত দর্শনও নয়। লেখক নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস কাঠামোর কথা খোলাখুলি স্বীকার করলেও, হাইপোথিসিসগুলো গঠনগতভাবে সব ধরনের বিশ্বাস ব্যবস্থায় প্রযোজ্য থাকে।
DAH মানুষকে কী বিশ্বাস করতে হবে তা বলে না; বরং মৃত্যু উপস্থিত থাকলেও সুসংহতভাবে বাঁচার জন্য মানসিকভাবে কী প্রয়োজন—তা স্পষ্ট করে।
বইটির শেষ অংশে মানসিক স্বাস্থ্যচর্চা, শিক্ষা, প্যালিয়েটিভ কেয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনায় এর ব্যবহারিক দিকগুলো আলোচনা করা হয়েছে। পাশাপাশি সীমাবদ্ধতা, সমালোচনা ও ভবিষ্যৎ গবেষণার দিকনির্দেশনা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা আছে—যেখানে DAH-কে একটি খোলা, বিকাশমান কাঠামো হিসেবে রাখা হয়েছে, কোনো বন্ধ সিস্টেম হিসেবে নয়।
এই কাজের কেন্দ্রে একটি স্পষ্ট বক্তব্য আছে: মানুষ শুধু টিকে থাকার জন্য বাঁচার কথা ছিল না।
মৃত্যুর সাথে অ্যাডজাস্টমেন্ট জরুরি—কিন্তু অর্থ ও দিক নির্দেশনা ছাড়া তা অসম্পূর্ণ।