অধ্যায় এক – আমাদের মনে মৃত্যু: কীভাবে এ ধারণা তৈরি হয় আর কেন এতে চাপ বাড়ে

মৃত্যু শব্দটা আমরা সবাই চিনি। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও এই শব্দটা শুনি। কিন্তু সত্যি কথা হলো—মৃত্যু আসলে কী, সেটা আমরা খুব কমই ঠিকভাবে বুঝি। বেশিরভাগ মানুষ নিজের জীবনে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার আগেই মৃত্যুকে নিয়ে একটা ধারণা মাথার ভেতর নিয়ে বড় হয়।

এই ধারণা আমাদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আসে না। এটা আসে অভিধান থেকে, সমাজের কথা থেকে, পরিবারের আচরণ থেকে, চারপাশের মানুষ যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায় সেখান থেকে। আর আসে এই ভাবনা থেকে—“একদিন আমি আর থাকব না”—এই চিন্তা আমাদের মনে যে ভয় বা অস্বস্তি তৈরি করে, সেখান থেকেও।

এই অধ্যায়ে আমরা সহজভাবে কয়েকটা বিষয় একসাথে বুঝতে চেষ্টা করব—

  • সমাজ আর অভিধান মৃত্যু বলতে কী বোঝায়
  • শিশুরা ছোটবেলা থেকেই মৃত্যুকে কীভাবে বুঝতে শেখে
  • মানসিক চাপ বা স্ট্রেস আসলে কী
  • আর কেন মৃত্যু যদি একেবারে সব শেষ হয়ে যাওয়া বলে ধরা হয়, তাহলে সেটা মানুষের মনে গভীর চাপ তৈরি করে

এগুলো আলাদা আলাদা আলোচনা না করে, আমরা একটানা গল্পের মতো করে দেখব—যাতে বোঝা যায়, মৃত্যুর ধারণা কীভাবে ধীরে ধীরে আমাদের মনে ঢুকে পড়ে এবং আমাদের না বুঝেই মানসিক চাপ তৈরি করে।


অভিধান আর মৃত্যুর সাধারণ মানে

আধুনিক সমাজে অভিধান খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো এমনভাবে লেখা হয় যেন ধর্ম বা ব্যক্তিগত বিশ্বাস ঢুকে না পড়ে। হাসপাতাল, আইন আর পড়াশোনার কাজে এগুলো ব্যবহার করা হয়।

অধিকাংশ অভিধানে মৃত্যু বলতে বোঝানো হয়—জীবনের শেষ, শরীরের কাজ স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যাওয়া, আর কোনো সাড়া না থাকা। অর্থাৎ, সবকিছুই বাইরে থেকে দেখা যায়—শরীর চলছে কি না, হৃদস্পন্দন আছে কি না।

এই সবকিছু মিলিয়ে একটা সহজ ধারণা তৈরি হয়— মৃত্যু মানে সব শেষ। আর কখনো ফিরে না আসা। দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিষয়টা এমনভাবে বুঝি— কেউ যদি কথা বলে, হাঁটে, সাড়া দেয়, আমরা বলি সে বেঁচে আছে। আর যদি এসব আর না থাকে, আমরা বলি সে মারা গেছে। এই ধারণা হাসপাতাল আর আইনের জন্য খুব দরকারি। এতে আত্মা, পরকাল, বা মানুষ ভেতরে কী অনুভব করছে—এসব নিয়ে কথা বলতে হয় না, কারণ সেগুলো বিজ্ঞান দিয়ে মাপা যায় না।

কিন্তু এতে একটা সমস্যা আছে। এই ধারণাটা পুরোপুরি বাইরের দিক থেকে বানানো। একজন মানুষ ভেতরে কীভাবে আছে, শরীর ছাড়াও আর কিছু আছে কি না—এসব এখানে ধরা পড়ে না। আমরা কিছু দেখতে না পারলে ধরে নিই, সেটা নেই। কিন্তু সত্যি বলতে গেলে, সেটা শুধু আমাদের জানার সীমা—বাস্তবতার সীমা নয়। তারপরও, এই বাইরের ধারণাটাই ধীরে ধীরে সমাজের কথা বলা আর ভাবার স্বাভাবিক ভিত্তি হয়ে যায়। আর সেই পরিবেশেই শিশুরা বড় হয়।


আমরা “অস্তিত্ব” কে কীভাবে বুঝি — আর কোথায় থেমে যাই

আমরা কাউকে জীবিত বলি তার শরীর দেখে — শ্বাস নিচ্ছে কি না, কথা বলছে কি না, নড়াচড়া করছে কি না। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বলি সে মারা গেছে, অর্থাৎ তার অস্তিত্ব শেষ। শরীর আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মনের ভেতরটা আমরা কখনোই সরাসরি দেখি না। আমরা শুধু আন্দাজ করি — কথা, মুখের ভাব, কাজ দেখে। ফলে এগুলোর অস্তিত্তের সমাপ্তিও শুধুমাত্র বাহ্যিক অনুমান বই নয়!

এ সময় আমরা মানুষের সব চিহ্নকে “গুরুত্বপূর্ণ” বলে ধরি না। যেগুলো অন্যের চোখে দেখা যায় না, সেগুলোকে আমরা এড়িয়ে যাই। এর ফল হলো—সমাজে অস্তিত্তের শেষ হবার মানে দাঁড়ায় “আমাদের কাছে কারো না থাকা।” আত্মা, পরকাল, বা সে মানুষটা নিজের ভেতরে কী অনুভব করতে পারে —এসব ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা ধর্মের বিষয় হয়ে যায়, কখনো আবার একেবারেই উপেক্ষিত হয়। আর এই ধারণাটাই ধীরে ধীরে শিশুদের মনে ঢুকে পড়ে।


শিশুরা কীভাবে মৃত্যুকে বুঝতে শেখে

মৃত্যু শুধু বড়দের বিষয় নয়। শিশুরাও ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বোঝে—এমনকি কেউ সরাসরি না বললেও। ছোটবেলায় শিশুরা বিচ্ছেদ বোঝে। মা বা পরিচিত কেউ সাড়া না দিলে তারা অস্থির হয়ে পড়ে। তাদের কাছে মৃত্যু মানে বড় বিচ্ছেদ – একটা খুব কষ্টের বিষয়।

আরেকটু বড় হলে তারা বড়দের ভয়, কান্না, দুঃখ দেখে বুঝে — মৃত্যু খুব ভয়াবহ ব্যাপার।

প্রি-স্কুল বয়সে শিশুরা ভাবে মৃত্যু মানে ঘুম বা কোথাও চলে যাওয়া। বড়রা অনেক সময় তাদের বোঝানোর জন্য বলে, “ঘুমিয়ে গেছে”। এতে তখন শিশুর শান্তি আসে, কিন্তু পরে তা সমস্যা তৈরি করতে পারে। যখন সে বোঝে মৃত্যু স্থায়ী, তখন তার ঘুম নিয়েও ভয় তৈরি হতে পারে।

স্কুল বয়সে তারা বোঝে—মৃত্যু সবার হয়, তার নিজেরও হতে পারে। তখন তারা প্রশ্ন করে —মরে গেলে কী হয়, কেন হয়। এই সময় তাদের ঠিকভাবে বোঝানো খুবই জরুরি। না হলে তারা ভয় আর কল্পনা দিয়ে নিজের মতো করে ধারণা বানিয়ে নেয়।

কিশোর বয়সে তারা সমাজের মৃত্যুর ধারণা পুরোপুরি গ্রহণ করে। যদি তখন শেখে — মৃত্যু মানে সব একেবারে শেষ, অর্থাৎ এর পর আর কোনো মানে নেই — তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই তাদের মধ্যে ভয়, হতাশা, রাগ তৈরি হতে পারে।

সমাজের আচরণে শিশু স্বাভাবিকভাবেই বোঝে—মৃত্যু ভীষণ কষ্টের বা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। কিন্তু তাদের শেখানোর জন্য সমাজ যদি বলে মৃত্যু শুধুই ঘুম বা অন্যত্র চলে যাওয়া, — তাহলে তাদের মানসিক ভেতরে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই দ্বন্দ্ব ছোটবেলা থেকেই ক্ষতি করতে পারে।


স্ট্রেস কী এবং কীভাবে কাজ করে

স্ট্রেস মানে—কোনো হুমকি বা চাপের সময় মন আর শরীরের প্রতিক্রিয়া। বেশি দিন থাকলে এ থেকে অসুখও তৈরি হতে পারে। স্ট্রেস ধাপে ধাপে হয় — প্রথমে ধাক্কা লাগে কোন অনাকাংখিত চাপে, তারপর স্বাভাবিক ভাবেই সতর্কতা তৈরি হয় সে চাপের ব্যাপারে, তারপর সে চাপ যদি রয়ে যায়, তাহলে এর পর আসে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, আর শেষে যদি বিষয়টা চিরকাল চাপই রয়ে যায়, মানিয়ে নেয়া সম্ভব না হয় – তাহলে ক্লান্তিই হয় চূড়ান্ত পরিনতি। দীর্ঘদিন এ ক্লান্তি থাকলে শরীর আর মন ভেঙে পড়ে।


মৃত্যুর ধারণা যখন স্ট্রেস

যদি কারো ধারণা হয় যে মৃত্যু মানে একেবারে সব শেষ, তাহলে নিজের মৃত্যু মানে সব সম্পর্ক একসাথে শেষ হয়ে যাওয়া; এতে স্ট্রেস খুব গভীর হবার কথা। আমরা জানি একদিন মরতে হবে, কিন্তু জানি না কখন। এই জানাটাই একটা বড় স্থায়ী চাপ যদি বিশ্বাস করি মৃত্যুতেই সব শেষ – একে মানিয়ে নেওয়ার কোনো সুস্থ পথ থাকে না। তখন মন মৃত্যুর কথা এড়িয়ে চলে। যদিও চাপ ভেতরে জমে থাকে। পরে সেটা নানা অজানা ভয়, অস্থিরতা, শরীরের সমস্যা হিসেবে বের হতে পারে।


সমস্যা আসলে মৃত্যু না, সমস্যা হল আমাদের ধারণা

প্রাকৃতিক ভাবে আসা নানা কষ্ট, বার্ধক্য, বিভিন্ন ক্ষতি—এসবের সঙ্গে কিছুটা হলেও মানুষ মানিয়ে নিতে শিখে। মৃত্যু যদি প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনা হয়, তাহলে তা মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের স্বভাবতই থাকা উচিত। কিন্তু আমরা তা পারি না। হয়তো সমস্যাটা আসলে মৃত্যু নয়, সমস্যা হলো আমাদের এই ধারণা —আমরা মৃত্যুতে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই। এই ধারণা আমাদের মন নিতে পারে না, কারণ অস্তিত্ব ধরে রাখার মধ্যেই যে জীবনের প্রধান আচরণ।

Leave a comment