বাংলাদেশের ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে ঘুরে ফিরে মাথায় একটা চিন্তাই আসছিল, কিভাবে দেশ/জাতির দীর্ঘ মেয়াদি টেকসই উন্নতি হতে পারে! প্রথম কয়েকদিন ভেবেছিলাম, খারাপ শাসক দূর হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সৌভাগ্য যে খারাপ শাসক দূর হল, কিন্তু দেখলাম তার পরপরই ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য খারাপ শাসকেরা আশে পাশে ঘুর ঘুর শুরু করে দিয়েছে। মনে দুশ্চিন্তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম, এবার কি হবে। ভালো মানুষে গড়া অন্তর্বর্তী কালিন সরকার এলো, স্বল্প সময় দেশ চালানোর জন্য; তাদের প্রতিশ্রুতি – সংস্কার কাজ শেষ করে যথা শীঘ্র সম্ভব ভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। মাথায় নতুন দুশ্চিন্তার উদয় হল। আমার জীবদ্দশায় কোন সৎ/যোগ্য/ভালো রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে দেখিনি; আমার মনে হয়েছে, জনগণের পছন্দের বিজয়ীরা বরাবরই জনগণের অনিষ্ট ডেকে এনেছে।
এক পর্যায়ে তাই মনে হতে লাগলো, আমরা, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কোথায় যেন আটকে আছি, আমাদের রুচি-দৃষ্টিভঙ্গি কোথায় যেন পচন ধরে আটকে আছে। অথচ এই আমরাই, পৃথিবীর নানা সমাজে গিয়ে ভালো হয়ে চলছি, ভালো কাজ করছি! এসব ভেবে মনে হল আমাদের বাংলাদেশীদের একটা জায়গায় বিশাল দুর্বলতা। এটা হল, আমরা নিজকে শাসন করতে জানিনা বা পারিনা, তাই অন্য কেউ আমাদের শাসন করলে আমরা অনেকটাই ঝরঝরে হয়ে যাই, তেমন কোন সমস্যা থাকে না। এখানে, আমরা বলতে আমি জাতির কথা বলছি না, ব্যাক্তির কথা বলছি। অধিকাংশ বাংলাদেশিই তার নিজকে নিয়ন্ত্রণ, শাসন বা উন্নয়নের প্রয়োজন বোধ করে না। শুধু যখন নিজের জীবনে সমস্যা বা কষ্ট নেমে আসে, তখনই ব্যাক্তি হিসাবে সংস্কার ভক্ত হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। মানুষ হিসাবে আমরা নিজের স্বার্থকে অসম্ভব বড় করে দেখি, এতটাই বড় করে দেখি যে তাকে পূজা করি। ভেবে দেখুন, আমরা সবাইকে ধৈর্যশীল আর সৎ হবার পরামর্শ দিলেও নিজের কাজের সময় ঘুষ দিয়ে সব সহজ করে নিতে ভালবাসি। আরও ভেবে দেখুন, অসৎ নেতাকে জাতিগতভাবে যতই ঘৃণা করি না কেন, নিজ স্বার্থ উদ্ধার হলে সেই নেতাকেই সাফল্যের দিকে এগিয়ে দেই, বের করে আনি নানা উসিলা – কেন খারাপ হলেও সে নেতাকেই চাই। আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সংস্কার আর উন্নয়ন আলোচনায় সময় দিলেও নিজের স্বার্থে ভুল কাজ করতে এক মিনিটও দিধা করিনা। আমার স্বার্থ সবার ওপরে, তার সাথে আর কোন কিছুরই তুলনা চলেনা, তার জন্য সবই করা যায় – এটাই জাতিগত ভাবে আমাদের ব্যাক্তিনীতি। ফলে অন্যের প্রক্ষাপটে মাঝে মাঝে আমরা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হতে পারলেও নিজের স্বার্থে স্বেচ্ছাচারী আর অপরাধ প্রবন প্রায় সব সময়ই।
মুহাম্মাদ ইউনুস নিজেকে উন্নত করার মধ্যে দিয়েই নোবেল জিতেছেন, কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি আপনাকে বা আমাকে উন্নত করার ক্ষমতা রাখেন না। ওই কাজটা একেবারেই আমাদের ব্যাক্তিগত। আর ব্যাক্তি পর্যায়ের অবক্ষয়ই বারবার রাস্তা তৈরি করে দেয় স্বৈরাচারী কিম্বা অপরাধ প্রবণ নেতৃত্বের জন্ম আর বর্ধনের। নিজেদের তৈরি করা দানবদের ততদিন আমরা সহ্য করি যতদিন নিজস্বার্থ পুজায় ব্যাঘাত না ঘটে। ফলে এক যুগ পরপর আমাদেরই সন্তানরা আমাদের পাপের কামাই পরিষ্কার করতে জীবন দেয়। ভীষণ লজ্জার এই প্রাপ্তবয়স্কের ব্যাক্তি চরিত্র! ভয়াবহ এই ব্যাক্তি স্বার্থের দাসত্ব! তাই স্বৈরাচার পালিয়ে গেছে কিম্বা সে অথবা অন্য কেউ আবার দেশে ফেরত আসবে এই চিন্তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ব্যাক্তি স্বার্থের শয়তানী পূজা বন্ধ করা, কারণ জাতীয় পর্যায়ের শয়তানের জন্ম ঠিক ওখান থেকেই হয়!