স্বর্গ-নরক

স্বর্গ নরকের ধারণা মানুষের সমাজে খুব পুরাতন। বিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেন এ তথ্য সৃষ্টিকর্তা মানুষকে জানিয়েছেন; অবিশ্বাসীদের ধারণা এটা মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে তৈরি করে নিয়েছে। এ বিষয়ে কে ঠিক তা নিয়ে যুক্তি তর্ক করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কারণ এটা প্রতিটা মানুষের ভেতরের জগতের সাথে সম্পৃক্ত যা অন্য কারো সাথে তর্ক করা অর্থহীন। বরং এ ধরণের তর্ক শেষ না হলেও এক ধরণের মাদকতা ছড়ায় যা মানুষকে ঠিক মদের মতোই অহেতুক মাতিয়ে রাখে।

যাহোক, স্বর্গ নরকের ধারণার জন্ম নিয়ে যে যাই বলুন না কেন প্রায় সবাই মানেন যে সমাজে এ ধারণার উপকারিতা রয়েছে। ভালো কাজের পুরষ্কার মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহিত করে আর খারাপ কাজের শাস্তি মানুষকে খারাপ থেকে দূরে রাখে; কোন সন্দেহ নেই এ ব্যাপারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এ ধারণা দুটো পৃথক ধারণার মিশ্রণ – একটা হল স্বর্গ, আরেকটা নরক। এ পৃথিবীর যেখানেই কোন মিশ্রণ ব্যবহার হয় সেখানেই অনুপাত জানা ভীষণ জরুরী। টক মিষ্টি আচার থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাস পর্যন্ত সব মিশ্রণেই অনুপাত ঠিক রাখা প্রায় বাধ্যতামূলক।

তাহলে ভেবে দেখুন, সমাজে যখন স্বর্গ-নরকের মিশ্রণ মানুষকে মনে করিয়ে দেয়া হচ্ছে, তখন কি ধরণের অনুপাত ব্যবহার করা হচ্ছে? প্রথমত, এ ধরণের কোন অনুপাতের কথা বাস্তব জীবনে আমরা খুব একটা ভাবিই না। অবশ্য ধর্ম গ্রন্থে এর বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, প্রতিদিনের জীবনে মূলত ভীষণ ধার্মিক কিম্বা ধর্ম প্রচারকগণই এ দুটো বিষয়ের কথা বলেন। আমি যে সমাজে বড় হয়েছি সেখানে মানুষকে নরকের ভয় দেখিয়ে মূলত ধর্মের দিকে আনা হয়। যদিও সততা ধর্মের মাপ কাঠিতে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ, সামাজিক ক্ষেত্রের অসততায় নরকের ধারণার ব্যবহার ততটা দেখা যায় না যতটা নির্দিষ্ট উপাসনার ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। যে কারনেই এ দুই ধারণার ব্যবহার হোক না কেন সেখানে ভারসাম্যের একটা বিরাট সমস্যা আছে বলে আমি মনে করি। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আমি ব্যক্তিগত ভাবে আমার সমাজ থেকে স্বর্গ নরকের যে পরিমাণ ব্যবহার দেখেছি তার শতকরা আশি ভাগ নরক কেন্দ্রিক, বিশ ভাগ স্বর্গকে ঘিরে। কখনো কখনো এ ভারসাম্যহীনতা আরও ব্যাপক।

এখন প্রশ্ন হল, ভারাম্যহীন এ মিশ্রণ বাস্তবে আমাদের কতটুকু কাজে আসে। প্রকৃতির নিয়মে দেখা যায়, মিশ্রণ যখন প্রয়োজনীয় ভারসাম্য ধরে রাখে না, তখন লাভ তো দূরে থাক, ক্ষতি হবার সম্ভাবনাও থাকে। আমার ব্যক্তিগত হিসাবে একটা উদাহরণ আমাকে এটা বুঝতে সাহায্য করে, হতে পারে আপনাদেরও এটা কাজে লাগবে। যখন কেউ গাড়ি বা সাইকেল চালাতে শেখে, যে দিকটায় চালক বেশি মনোযোগ দেয়, গাড়ি বা সাইকেল সে দিকটায় অনেক সময়ই বেঁকে যায়। এজন্য অনেক নতুন চালক একদিকে বিশেষ কিছু দেখতে হলে নিজেকে আগে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে নেয় যেন গাড়ি বা সাইকেল ঐ দিকে ঘুরে না যায়।

উপরের উদাহরণ যদি নির্ভরযোগ্য হয়, তাহলে আমাদের সামাজিক শিক্ষার প্রেক্ষাপটে নরক-প্রীতি আমাদের পরিবর্ধনের দিক খারাপে ঘুরে যেতেও সাহায্য করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এক তরফা স্বর্গের স্মরণ যে মানুষকে শুদ্ধ করে দেয় তারও বিশেষ কোন নজির নেই। এক্ষেত্রে গাড়ি চালকের উদাহরণটা আমাদের আবারও সাহায্য করতে পারে। চালক যখন সোজা যেতে চান, তখন তিনি ডান আর বাম দিকে সম পরিমাণ মনোযোগ দেন; তবে গাড়ি যদি ডানে বা বামে বাঁক নেবার প্রয়োজন থাকে, তাহলে চালকের মনোযোগ সে দিকে কিছুটা বেশি থাকে। মানুষের জীবনে স্বর্গ নরকের যা পরিচয়, সে অনুযায়ী কেউই চান না যে তার বা অন্যের জীবন নরকের দিকে বাঁক নিক। তাই সেখানেও, স্বর্গ-নরকের ধারণা যখনই ব্যাবহার হবে তখনই স্বর্গের ভাগটা সে মিশ্রনে একটু হলেও বেশি থাকা চাই। তাহলে হয়তো গতিপথের বাঁকটাও সে দিকে হবে।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, যেখানে ভালো কিছুই হয়না, সেখানেও কি স্বর্গের ধারণা বেশি হতে হবে? আমার মতে, হ্যাঁ! যুক্তি হিসাবে আমি বলব, নরকের আহ্বান যতই প্রবল হোক না কেন, একটু ক্ষমা তাকে অনেক সময়ই আটকে দিতে পারে, এগিয়ে নিতে পারে স্বর্গের পথে। তবে সাবধান, যেভাবে অতি নরক চর্চা কাজের নয়, অতি স্বর্গ চর্চাও তাই। শুধু মনে রাখতে হবে দুটোর মধ্য যেটা আমাদের কাম্য, তার চর্চা যেন সামান্য হলেও বেশি হয়।

One thought on “স্বর্গ-নরক

  1. Judaism relies more on motivating by fear, Christianity relies more on motivating by words of love, Islam is the synthesis a perfect balance between hope and fear. But for that, you have to explain Islam in the way Rasulullaah (SWS) explained, not in the way our clergy explains nowadays.

    Like

Leave a comment