মানুষের ভেতরে মানুষ -জগতের ভেতরে জগত

মানুষ স্রষ্টার এক অদ্ভুত সৃষ্টি। যে দেহটাকে দেখিয়ে আমরা বলি – এটাই মানুষ, তা আসলে মানুষের দেহ, পুরনাঙ্গ মানুষ নয়। এই দেহের সাথে যুক্ত রয়েছে মানুষের এক অদৃশ্য অংশ। মন, আত্মা, চেতনা ইত্যাদি শব্দ সেই অদৃশ্য অংশের সাথে সম্পর্কিত। দেহ আর তার ভেতরের ঐ অদৃশ্য অংশ নিয়ে তৈরি হয় একজন পুরনাঙ্গ মানুষ।

ভেতরের ঐ অদৃশ্য সত্ত্বাটাই হল মানুষের মূল অংশ। দেহটা হল ঐ মূল অংশের জন্য এক ধরণের পোশাকের মতো। তবে এটা যেন তেন পোশাক নয়। মহাকাশে নভোচারী যে ধরণের পোশাক পরে মহাকাশে টিকে থাকে কিছুটা সে ধরণের। তবে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি জটিল। দুনিয়ার বুকে মানুষ হিসাবে উপস্থিত থাকতে দেহ নামের এই পোশাক বাধ্যতামূলক। এটা বানানো জীবন্ত সব উপাদান দিয়ে যারা সাধারণ ভাবে দেহ কোষ বলে পরিচিত। আর তাই তো মানুষ মরে গেলেও দেহটাকে নানা যন্ত্র দিয়ে জীবিত রাখা হয় যেন তাকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজে লাগানো যেতে পারে।

ভেতরের সত্ত্বাটাকে দেহ ব্যবহার করে পৃথিবীর বুকে চলতে ফিরতে হয়। ভেতরের অংশ যতই সংবেদনশীল হোক না কেন দেহের সংবেদনশীলতা মাত্র পাঁচটা ইন্দ্রিয়ে সীমাবদ্ধ। তাই বলা যায়, অজ্ঞাত এক কারণে ভীষণ সংবেদনশীল এক সত্ত্বাকে সীমিত সংবেদনশীলতার পোশাক “দেহ” পরিয়ে মাঠে নামানো হয়েছে। অথবা এটা অনেকটা লন্ডনে বসে নিউ ইয়র্কের রোগীর শরীরে অস্ত্রপ্রচারের মতো যেখানে সার্জন লন্ডনে বসে অনলাইন যন্ত্রের মাধ্যমে নিউ ইয়র্কে শুয়ে থাকা রোগীর শরীরে অস্ত্র প্রচার করছেন। আরও সহজ করে বললে, এটা সেই খেলার মতো যেখানে খেলোয়াড় কম্পিউটারে বসে পর্দায় দৃশ্যমান দেহ গুলোকে দিয়ে খেলিয়ে নিচ্ছে।

মানব দেহ এক অবাক করা পোশাক। সে তার চারপাশের সব তথ্য গ্রহণ করে ভেতরের আপাত অদৃশ্য অংশের কাছে সেগুলো পৌঁছে দেয়। ভেতরের সেই অংশের চিন্তাগুলোকে পার্থিব রূপ দিতে দেহই তাকে ভাষায় রূপান্তরিত করে প্রকাশ করে। সে ভাষা আবার কথা হিসাবে অন্য আরেক দেহে পৌছলে সে দেহের ভেতরের সত্ত্বা সেগুলোকে চিন্তা হিসাবে বুঝতে পারে। এভাবেই এক ভেতরের মানুষ আরেক ভেতরের মানুষের সাথে যোগাযোগ করে। এটা অনেকটা অনলাইনে দুজন মানুষের যোগাযোগের মতো, যেখানে কম্পিউটারে দৃশ্যমান দেহগুলো একে অন্যের সাথে ক্রিয়ারত থাকে আর তাদের প্রত্যেকের পেছনে একজন করে প্রকৃত মানুষ কম্পিউটারের বাইরে বসে। এতে যা কিছু ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া চলে তা মূলত ঐ মানুষদের মাঝেই, কম্পিউটারে দৃশ্যমান শরীর গুলো এখানে সহায়ক উসিলা ছাড়া আর কিছুই না।

আমাদের ভেতরের ঐ মানুষগুলো ঠিক কোথা থেকে কিভাবে আমাদের দেহ গুলোকে দিয়ে খেলিয়ে নিচ্ছে তা বলা মুশকিল। তবে এটুকু পরিষ্কার যে তাদের সরাসরি খেলার পরিবর্তে আড়াল থেকে খেলতে হচ্ছে। মোটেও সহজ নয় এ খেলা। ভুলভ্রান্তি থাকাটা এ খেলার জন্য ভীষণ স্বাভাবিক, অনেকটা যেন বাধ্যতামূলক। দেহ যেন এক প্রতিবন্ধকতা যা ভেতরের মূল সত্ত্বাকে অনেকগুণ দুর্বল করে রেখেছে; ঠিক যেমন চক্ষুষ্মানের জন্য ঘষা কাচের চশমা, যা পরে কর্মক্ষম থাকা তো দূরে থাক, দেখাই দায়!

যখন এক মানুষ অন্য মানুষের সাথে সামাজিক কারণে মুখোমুখি হয় তখন দেহের তৈরি আড়াল ভালো সুস্পষ্ট যোগাযোগের পথে এক নিয়মিত বাধা। তাইতো মানুষ আদর্শ, সুন্দর আর সহজ দৈহিক আচরণের মধ্য দিয়ে সামাজিক যোগাযোগের বিভ্রাটগুলোকে যথাসাধ্য সীমিত রাখতে চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য খুব সহজ, ভেতরের মানুষটাকে যথাসাধ্য স্পষ্ট করে প্রতীয়মান করা। একবার ভেবে দেখুন, যখন সামাজিক যোগাযোগের জন্য ঐ দেহগুলোও আবার আড়ালে থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় যোগাযোগ করে, তখন চরম ভেতরের ঐ অশরীরী মানুষ গুলোর মধ্যে ব্যবধান আরও কতটা জটিল আর গভীর হয়ে যায়! হতে পারে তখন এক মানুষ অন্য মানুষকে অদৃশ্য সত্ত্বার পর্যায়ে আর আদৌ উপলব্ধি করতে পারেনা।

অথচ এতটা জটিল আর দুর্বল হবার পরও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার কিন্তু ক্রমশই বেড়েই চলেছে, বিশেষ করে মানুষে মানুষে যোগাযোগের নামে। এর পেছনে অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণও থাকতে পারে। প্রথমত, সামগ্রিকভাবে মানুষ ক্রমশই ভেতরের সত্ত্বাকে আড়াল করার ব্যপারে অধিক অগ্রহি হয়ে উঠছে। দ্বিতীয়ত, সামাজিকতার নামে নিজের পছন্দমতো প্রদর্শনীই মানুষ চায়। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে ভয়াবহ কারণ যেটা হতে পারে তা হল, আমরা আমাদের ভেতরের মানুষটাকে বাচিয়ে রাখার আগ্রহ ক্রমশই হারিয়ে ফেলছি; ফলে বাহ্যিক, এমনকি মিথ্যা কিছু ব্যাবহার করতে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যোগাযোগে আমরা প্রায় বন্দি হয়ে পড়ছি।

ওপরের যেটাই সঠিক কারণ হোক না কেন, ফলাফল কিন্তু মানুষের ভেতরের সত্ত্বার জন্য ভয়াবহ। নিতান্ত অবহেলায় অনেকটা কবর চাপা দেয়া অবস্থায় ভেতরের সত্ত্বা গুলোয় মরিচা ধরে তারা আজ ধ্বংসপ্রায়। দেহ যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন ভেতরের সত্ত্বা যখন মৃত প্রায় তখন মানব জীবনের আর কিছুই থাকেনা – ঠিক যেমন কোমাতে চলে যাওয়া মানুষের দেহ যা যন্ত্রের মাধ্যমে কর্মক্ষম রাখা হয়েছে। আর তাই তো আজকাল আমাদের আনন্দে ভরপুর এই ভারচুয়াল মিডিয়ার জীবনকে প্রায়ই মৃত বলে মনে হয়, আর আমরা আরো বেশি বেশি করে ভারচুয়াল আনন্দের খোঁজে ঝাপিয়ে পড়ি জীবনটাকে শুধু একটু উপভোগ করতে ! ভুলেই যাই, ম্রিতের জগতে জীবন উপভোগ নিতান্ত পরিহাস ছাড়া আর কিছুই না!!

Leave a comment