এক তরফা ডিনায়েল অফ ডেথ নিয়ে ভাবছি বেশ অনেক বছর হল। এটা সত্য যে আমাদের মধ্যে ডিনায়েল অফ ডেথ এর মাত্রা খুবই তীব্র; এতটাই তীব্র যে এটা ব্যক্তি এবং সমাজের জন্য এক বড় সমস্যা। তাই ডেথ এন্ড অ্যাডজাস্টমেন্ট হাইপোথিসিস দিয়ে আমি বুঝার চেষ্টা করেছি কিভাবে আমরা এই পর্যায়ে এলাম। এটাকে আমি এখনও ভালো ইনটারপ্রিটেশন মনে করি। তবে যা এতে করা হয়নি, তা হল মৃত্যুকে অপছন্দ করা বা এড়িয়ে চলার প্রয়োজনীয় দিকটা । আসলে মৃত্যুকে স্মরণে রাখা এবং ভুলে থাকার ভারসাম্যের মধ্যেই জীবনের স্থিতি। তাই স্বীকার করছি, যা আমার করা উচিত ছিল, এই ভারসাম্যের জন্য কাজ করা। যাহোক, দেরিতে হলেও কাজটা শুরু করতে চাই।
খুব সহজ করে ভাবতে চাই বিষয়টা নিয়ে। তাই ঠিক করেছি একজন করে চরিত্র উপস্থাপন করবো যারা প্রত্যেকে একেক ধরণের দলের প্রতিনিধি। এরা সবাই কাল্পনিক চরিত্র, বাস্তবের কাউকে উদ্দেশ্য করে লেখা নয়।
প্রথম যার কথা লিখবো তার নাম ধরে নেই তুর্য। জীবনের ব্যাপারে সে উচ্চাকাংখি। সে জানে খুব বেশি জিনিসের ব্যাপারে কাজ করে কোন ক্ষেত্রেই সে খুব ওপরে উঠতে পারবে না। তাই একটা পথ বেছে নিয়েছে সে যা দিয়ে সে ওপরে উঠবে, অনেক ওপরে, এতো ওপরে যে সে নিজেও ভালো করে জানে না তা ঠিক কোথায়। ভীষণ ব্যস্ত জীবন তার। একের পর এক চর্চা আর তারপরই অর্জন; তারপর আবার নতুন চর্চা যার পেছনেই নতুন অর্জন। সে জানে, সময় নষ্ট করার কোন সুযোগই তার নেই।
দ্বিতীয় যার কথা লিখবো তার নাম জামিল। সেও উচ্চাকাঙ্ক্ষী, তবে একটু ভিন্ন ভাবে। সে চায় জীবনের প্রায় সব কিম্বা সম্ভব হলে সব ক্ষেত্রেই ভালো করতে। কথাবার্তা, পোশাক আশাক, চালচলন, চিন্তা, পড়াশুনা, চাকুরী, খ্যাতি – কি না! তাই ফলাফলে, কোন দিকেই খুব বেশি ভালো করা হয়ে ওঠেনা তার, মনও সেরকম চায়না। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার মূল যে প্রতিচ্ছবি বাইরে থেকে দেখেতে পাওয়া যায় তা হল, সে খুঁতখুঁতে, বিশেষ করে নিজের ব্যাপারে খুব কঠোর।
তৃতীয় যার কথা লিখবো তার নাম হাসান। সে চায় বুদ্ধিমত্তায় শীর্ষে থাকতে। সে জানে, ওপরে ওঠা যদি রাজনীতি জাতীয় কিছু দিয়ে শুরু করা যায় তাহলে এক সময় সে বিনা পরিশ্রমে সমাজের মুকুট হয়ে থাকতে পারবে, কোন কিছুরই অভাব হবে না। তাই সে বুঝে নিতে চায় মানুষের চিন্তা ভাবনার সাধারণ গতি প্রকৃতি, শিখে নিতে চায় মানুষকে সন্তুষ্ট আর সম্মত করার সব রকম পথ। পরিবার থেকে সমাজ, কাউকেই সে এ হিসাবের বাইরে রাখতে চায়না।
চতুর্থ যার কথা লিখবো তার নাম জাহিদ। সে বিশ্বাস করে যে তার বুদ্ধিমত্তা অন্যদের চেয়ে উঁচু মানের। সে বোঝে যে শুধু চেষ্টায় কাজ পুরা হয়না। সফল হতে চাই সৃষ্টিকর্তার সাহায্য। এমনকি তিনি সাহায্য করলে রাতারাতি জীবন পালটে যেতে পারে। তাই সে মনোযোগ দিয়েছে ধর্মকর্মের দিকে। ঠিক কোন ধরণের প্রার্থনায় কি সুফল পাওয়া যায় – এগুলো নিয়ে সে প্রচুর পড়াশোনা আর চর্চা করে। সমাজের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডতে সে নিয়মিতই অংশ নেয়। সে বিশ্বাস করে, এটাই ওপরে ওঠার কার্যকর পথ।
পঞ্চম একজনের কথা লিখবো তার নাম জামাল। সে জীবনে সুখি হতে চায়। নিজেকে খুশি রাখতে চায়। এর জন্য যা দরকার সে সবই করতে রাজি। আনন্দ, ফুর্তি, উজ্জাপন নিয়ে তার ব্যস্ত সময় কাটে; আর যারা এগুলো বোঝেনা তাদের এড়িয়ে চলে, যেন তার নিজের জীবনের ওপর ওদের প্রভাব না পড়ে। তার এমন ভাবার মূলে যা আছে তা হল, জীবন সীমিত। তাই একমাত্র আনন্দ ফুর্তি করেই জীবনটা পার করা উচিত। অন্য যা কিছুই মানুষ করুক না কেন, তা করার মতো যথেষ্ট সময় মানুষের জীবনে থাকে না।
মুলত ওপরের এই পাঁচ ধরণের চরিত্রই ডেথ ডিনায়েল বা মৃত্যুকে যথা সম্ভব অস্বীকার করার সাথে মেলে। মৃত্যুকে প্রতিস্থাপন তুর্যকে করতেই হবে; নাহলে তার পছন্দের পথে অসীম উন্নতি সে কিভাবে করবে! জামিল হল তুর্য চরিত্রের সামান্য পরিবর্তন যেখানে এক পথে সফল হবার চেয়ে সব পথে সফল হবার আগ্রহ বেশি। হাসান হল তুর্যের সুবিধাবাদি রূপ। একই ভাবে তুর্য যখন সমাজের প্রচলিত পথে উপরে ওঠাকে কোন কারণে এড়ানোর চেষ্টায় ধর্মের সাহায্য নিচ্ছে, তখনই সে জাহিদ। আর তুর্য যখন একটু দুর্বল বা ভিতু মনের, তখনই সে জামাল।
কিন্তু তাহলে কি এই পাঁচ পথের সব পথই ভুল, বিশেষ করে যদি ডেথ ডিনায়েল এর সাথে তুলনা করা যায়? না। ওপরের পথ গুলো যতটা না ভুল বা ঠিক, তার চেয়ে চরিত্রের মাত্রাগুলো বেশি সমস্যাদায়ক। এখানে, ওপরের সবাই চরমপন্থি। এই চরম মাত্রাটা মৃত্যু ভুলে থাকার সবচেয়ে বড় চিহ্ন। অথচ আমার আগের চিন্তা ভাবনায় ভোগবাদ ছিল মৃত্যুকে ভুলে থাকার মূল চিহ্ন। এটা সত্য যে ভোগবাদ মৃত্যু ভলে থাকতে সাহায্য করে। কিন্তু এটাও ঠিক যে মৃত্যুকে স্মরণ করাটাও স্বাভাবিক সীমার মধ্যে রাখতে হবে, আর সে সীমা বজায় রাখতে ভোগ খুবই সহায়ক। তবে তার মানে এই নয় যে আমি ভোগবাদী হতে বলছি; আমার কাছে, যে ভোগে চরম সেই ভোগবাদী!
এখন ভেবে দেখুন, যে চরম মাত্রায় মৃত্যুর কথা ভেবে চলেছে তার কথা। তাহলে এবার একটা ষষ্ট চরিত্র আনা যাক। আমিন সকলের চোখে ভালো একজন মানুষ। সে ধার্মিক। সে মেধাবি। অথচ সে কিছুতেই জীবনে ভোগের গুরুত্ব স্বীকার করতে পারে না, মৃত্যু যেখানে আছে সেখানে ভোগের গুরুত্ব সে কিভাবে দেবে? যখন যা কিছুতেই সে হাত দেয়, তার মনে হয়, মরেই তো যাবো একদিন! এদিকে ধর্মের সুবাদে সে পরকালের কথা জানে। তাই ঠিক করেছে, পরকালে উন্নতি করতে সে নিয়মিত কাজ করে যাবে। তারও মনে চায় যে মৃত্যুর আগের সময়টাও অন্য সবার মতো উত্তেজনা আর আনন্দে কাটুক, কিন্তু মৃত্যুকে যেহেতু অস্বীকার করার কোন উপায়ই নেই, সে এগুলো এড়িয়ে চলে।
দেরিতে হলেও বুঝতে পারি, এই ষষ্ঠ চরিত্রটাও চরম। ভোগের চরম সাধ তার। কিন্তু চরমভাবে সে সাধ মেটানো সম্ভব নয় বলে সে পুরোটাই ত্যাগ করেছে। স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করেছে পরকালকে ঘিরে। অথচ জীবনকে যে অগ্রাহ্য করবে সে পরজীবনকে দেখবে কেমন করে ? দেখার চোখ আর ভাবার মন, সেও তো এই জীবনের অংশ! আমাদের জীবনটা আসলে অনেকটা হাত মোজা সহ হাতের মতো। ভেতরে আসল জিনিসটা থাকলেও ওপরের ওই মোজা সহই সব কিছু করতে হবে যতক্ষণ না মোজা খোলা সম্ভব হয়। মোজাকে সানন্দে মানিয়ে নিতে না পারলে হাত আর মোজার দন্দে পার হয়ে যাবে জীবনের সময়টা।
Reblogged this on ত্রিভুজ.
LikeLike
Excellent thought. The distinction between the five characters are not easy to understand for everyday reader thought.
LikeLike